short-story-mamla

মামলা
সুমন্ত আসলাম


সদানন্দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাব্বির মোসাদ্দেকের বাঁ গালে মশা বসেছে একটা। ব্যাপারটা তিনি টের পেয়েছেন। জায়গাটা কুটকুট করছে, চুলকাচ্ছেও একটু একটু। ঠিক ওই সময়টাতে কন্সটেবল বাতেন সরদার ঢুকলেন রুমে। স্যারের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শব্দ করে বললেন, ‘ছার, আপনার গালত মশা!’
‘কোন গালে, বাতেন?’
‘বাও গালে।’
‘ছোট, না বড়?’
‘ছোটই তো আছিল বোদঅয়, রক্ত খাইয়া বড় অয়া গ্যাছে।’
‘খাক। সামান্য রক্তই তো। একটা প্রাণী আমার গায়ের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকবে, এটা তো বড় আনন্দের ব্যাপার, বাতেন।’ চেয়ারে ঠেস দিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে?’
‘কী কাজ ছার?’
‘মশাটা মারতে পারবে?’
‘পারমু ছার।’ দু পা এগিয়ে এলেন বাতেন সরদার। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোর মতো বললেন, ‘কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’ তাড়া দেন সাব্বির মোসাদ্দেক।
দু’পাশে ঝুলানো হাত দুটো নিজের তলপেটের কাছে আনলেন বাতেন সরদার। পরস্পর চেপে ধরে শরমিন্দা করে ফেললেন পুরো চেহারা। টুলটুল করে তাকিয়ে ছিলেন তিনি এতক্ষণ, নিচু করে মেঝেতে ঝুকালেন মাথাটা।
সাব্বির মোসাদ্দেক মুচকি একটা হাসি দিলেন, ‘কয়দিন ধরে তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করছো, কিন্তু জবাব দিতে পারিনি সেটার। সম্ভবত জবাবটা পেয়ে গেছো।’
‘জে, ছার।’
‘একটা মশা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে গেছে, তোমার খুব ইচ্ছে করছে মশাটাকে মারতে, কিন্তু মশাটা আমার গালে বলে মারতে পারছো না, ইতস্তত করছো, সংকোচ করছো, ভয় করছো।’ চেহারা সামান্য ম্লান করলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘এই চেয়ারে বসে আমি অনেক কিছুই দেখি, বুঝি, কিন্তু কিছুই করতে পারি না। আমারও ইতস্ততা আছে, সংকোচ আছে, ভয় আছে।’ সোজা হয়ে বসলেন সাব্বির মোসাদ্দেক। আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে বললেন, ‘যাও, মুড়ি নিয়ে আসো। মুড়ি খাওয়ার সময় হয়েছে আমার।’




হাতের ফাইলটা পাশে রাখলেন সাব্বির মোসাদ্দেক। কন্সটেবল বাতেন সরদার এক বাটি মুড়ি আর তিনটি কাচামরিচ এনে রাখলেন টেবিলে। বাঁ হাতে একটা মরিচ নিলেন তিনি, ডান হাতের মুঠোয় মুড়ি। মুখে পুরলেন মুড়ি। মরিচটা দাঁতের ফাঁকে দিতে নিয়েই থেমে গেলেন। হাতটা আরো একটু উঁচু করলেন। সরু করে ফেললেন চোখ, ভাঁজ করে ফেললেন কপাল। মরিচটার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বললেন, ‘বাতেন, আমাদের সমন্ধে আম-পাবলিকের ধারনা কী, জানো তো?’
‘জে, ছার।’
‘পুরোটা জানো?’
‘জে, ছার।’
‘না, জানো না।’ সাব্বির মোসাদ্দেক মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, ‘পুলিশ, বিশেষ করে থানার ওসি সাহেবরা নাকি কোনো কিছু কিনে খান না। দাম না দিয়ে মাগনা খান।’
‘কথাটা আপনার বেলায় সত্য না, ছার।’
‘কিন্তু পয়সা দিয়ে তো এরকম মরিচ আমি কখনো খাই না, বাতেন।’ সাব্বির মোসাদ্দেক মরিচটা এগিয়ে দিলেন বাতেন সরদারের দিকে, ‘এরকম মাথা মরা মরিচে রুচি হয় না আমার।’
‘দুঃখিত ছার, এখনই বদলায়া আনতাছি।’
‘না।’ প্লেটে রাখা বাকী মরিচ দুটোর দিকে তাকালেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘এ দুটো ভালো আছে। পরেরবার ভুল করবা না। মানুষ পান খায়, সিগারেট খায়, এটা ওটা নানান জাতীয় জিনিস খায়। আর আমি খাই মুড়ি। মাত্র এক বাটি মুড়ি, সঙ্গে তিনটি কাচা মরিচ।’
বাতেন সরদারের দিকে কৌতুকভরা চোখে তাকালেন তিনি, ‘আমাকে কি আর কোনো কিছু খেতে দেখেছো কখনো, এই অফিসে?’
‘না, ছার।’
‘আমি কিন্তু ঘুষও খাই না।’
‘জে, ছার।’
‘ঘুষ খেলে নাকি সংসারে অশান্তি হয়, আমি কিন্তু ঘুষ না খেয়েও অশান্তিতে আছি।’ কচ করে মরিচে একটা কামড় দিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘তোমার ম্যাডাম কয়দিন আগে আমাকে একটা অঙ্ক দিয়েছে।’ মুখের মুড়িগুলো একটু চাবিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘অঙ্কটা কী, শুনবে?’
বুঝতে পারা আর না পারার মাঝামাঝি অবস্থানে বাতেন সরদার। মুখে আরো এক মুঠ মুড়ি চালান করলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, একটা কামড়ও দিলেন মরিচে। আয়েশ করে চাবাতে চাবাতে বুজে ফেললেন দু চোখ, ‘কান্দাখার থানার ওসি সাহেবকে চেনো তো?’
‘জে, ছার।’
‘তিনি যত টাকা বেতন পান, আমিও ওই একই টাকার বেতন পাই। কিন্তু তিনি এরই মধ্যে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন চার বেডরুমের। আমি কিনতে পারি নাই। নতুন ছাপ্পান্ন ইঞ্চির একটা প্লাজমা টিভি কিনেছেন কয়দিন আগে। আমার বাসারটা বত্রিশ ইঞ্চির, পুরোনো মডেলের। প্রায় ছয় ফুট লম্বা একটা ফ্রিজ আছে তার, রাজহাঁসের মতো সাদা। আমারটা অনেক আগের, নিচের দিকে জং পড়ে গেছে। তিনি যে মোবাইল ইউজ করেন, তা দিয়ে আমি অন্তত তিনটি মোবাইল কিনতে পারব।’
টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘এ সবই ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে অন্য জায়গায়।’ একটু থামলেন তিনি, ‘কোন জায়গাটায়, জানো?’
‘জে না, ছার।’
‘আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে বেড়াতে যায় ওই বাসায়, আমিও যাই। কান্দাখার থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী যে পরিমাণ গয়না প্রদর্শন করেন শরীরে, আর আলমারী খুলে প্রতিমাসে কেনা যতগুলো শাড়ীর সংখ্যা দেখান আমার স্ত্রীকে, বাসায় এসে আমার স্ত্রী চুপ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রান্নাঘরে গিয়ে চা বানায়। এই চা বানাতে গিয়ে যে পরিমাণ শব্দ করে, সারাদিন রান্না করলেও এতো শব্দ হয় না কখনো। চা বানিয়ে এক সময় আমার সামনে এসে বসে। যা বুঝার বুঝে যাই আমি। এটা ওটা বলতে বলতে একসময় বলে- দু’জন ওসি একই টাকা বেতন পান, কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা দু’রকম। বলেন তো সদানন্দপুর থানার ওসি সাহেব, ছোটকালে কত কেজি দুধ খেলে একজন হয় বুদ্ধিমান, না খেলে হয় বোকার হদ্দ? ঐকিক নিয়মে অঙ্কটা বের করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাও আমাকে।’
‘অঙ্কটা কি খুব কঠিন ছার?’
‘কঠিন কী, এরকম অঙ্ক তো আমি কখনো শিখিইনি, উত্তরও জানা নেই তাই।’ সাব্বির মোসাদ্দেক আরো একটু হেসে নেন, ‘বাতেন, তুমি পারবে নাকি অঙ্কটা?’
বাতেন সরদার কিছু বলেন না, নিচু করে ফেলেন মাথাটা।
‘লজ্জা পেলে, বাতেন?’
‘না ছার, কষ্ট হচ্ছে আপনার জন্য।’
‘একটা কাজ করো।’ বাটির শেষ মুড়িটুকু হাতের মুঠোয় নিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘এক কাপ চা নিয়ে আসো ফয়েজের দোকান থেকে। চিনি কম দিতে বলবে।’
‘আপনি তো চা খান না কখনো!’
‘আজ খেতে ইচ্ছে করছে। পারলে একটা পানও নিয়ে এসো, জর্দা ছাড়া। ভালো কথা…’ পকেটে হাত ঢুকালেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘তুমি যে মুড়ি-টুরি খাওয়াও আমাকে, দাম-টাম ঠিকমতো নাও তো? এই ধরো, টাকাটা রাখো।’ বাতেনের দিকে একশ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক।
‘ছার, আগের তো চল্লিশ-পয়তাল্লিশ টাকা এখনও আছে আমার কাছে।’
‘বাতেন, আমি মুড়ি খাই, কাঁচা মরিচ খাই। তোমারও তো কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে। নাকি করে না? যাও যাও, চা নিয়া আসো। পারলে কিছু খেয়েও আসো।’




কাপটা হাতে নিয়ে চা দেখতে ছিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক। সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। রং পছন্দ হয়েছে চায়ের। গন্ধটাও চমৎকার। কিন্তু ঠোঁট আর হাতের মাঝামাঝিতে কাপটা আনতেই থেমে গেলেন তিনি। বাতেনের চোখের দিকে তাকালেন। চেহারাটা ম্লান করে বললেন, ‘বাতেন, তুমি আজও কিছু বলতে চাও। আমি জানি, তুমি কী বলতে চাও। আজও আমি তোমার কথাটা শুনব না। তবে একটা কথা মনে রেখো, জগতের শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ হচ্ছে সেই জন, যার সৎ একটা হৃদয় আছে। আপাতদৃষ্টিতে যাদের দেখে সুখী মনে করি আমরা, তাদের কাছে গিয়ে দেখবে-তাদের বুকে যে শব্দ হয়, ওটা আর কিছু না, ভালো করে শুনে দেখো কান্না আর বেদনার শব্দ!’
জড়তার একটা হাসি দিলেন বাতেন সরদার।
‘তুমি এখন যাও। চা পানি খাও। দরজার ফাঁক দিয়ে বুড়ো একটা মানুষকে দেখলাম, কে উনি?’
‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
‘পাঠিয়ে দাও। তার আগে আরও এক বাটি মুড়ি দাও, সঙ্গে তিনটা না, দুটো মরিচ দিও এবার।’




দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে স্কুলের পণ্ডিত স্যারের কথা মনে পড়ে গেল সাব্বির মোসাদ্দেকের। মোটা ফ্রেমের কালো চশমাটা ঈষৎ নেমে এসেছে নাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সারা মুখে কদম-ছাট দাড়ি, শরতের কাশ ফুলের মতো সাদা, জীবন্ত।
‘আসুন।’
সাব্বির মোসাদ্দেকের রুমে ঢুকলেন মানুষটি। সাদা ধুতিটা সেই কবে ঘোলাটে হয়ে গেছে, পরনের ফতুয়াতে শত ভাঁজ। পা দুটো খালি, ডান হাতে একটা কাগজ।
‘বসুন।’ সামনের চেয়ারটা দেখালেন সাব্বির মোসাদ্দেক।
মানুষটি বসলেন। কিছুটা কাঁপছেন তিনি, কেঁপে উঠল চেয়ারটাও। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন সাব্বির মোসাদ্দেক। দ্রুত গলায় বললেন, ‘পানি খাবেন?’
জবাব দিলেন না মানুষটি, তবে সায় দিলেন নীরবতায়। কিছুটা সংকোচিতও হয়ে গেলেন। টেবিলে রাখা নিজের পানি ভর্তি গ্লাসটা মোসাদ্দেক এগিয়ে দিলেন তার দিকে। পুরো এক ঢোকেই শেষ করে তিনি গ্লাসটা টেবিলে রাখলেন আবার। মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘মুড়ি খান, বেশ মচমচে মুড়ি।’
মাথা এদিক-ওদিক করলেন মানুষটি। সাব্বির মোসাদ্দেক বাটিটা নিজের দিকে আনলেন, ‘অন্য কিছু?’
মানুষটি মাথা এদিক-ওদিক করলেন আবার।
হাতের মুঠোয় কতগুলো মুড়ি নিলেন সাব্বির মোসাদ্দেক। ওগুলো মুখে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কী মনে করে দিলেন না। বাটিতে রেখে দিলেন, রেখে দিলেন বাঁ হাতের মরিচটাও। দু হাতের কনুই টেবিলে ঠেকালেন। গলাটা সরল করে বললেন, ‘কোনও সমস্যা?’
‘জি।’
‘বলুন।’
কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন মানুষটি। সাব্বির মোসাদ্দেক খেয়াল করলেন, দ্বিধা কাজ করছে মানুষটির মাঝে। অপ্রস্তুতও দেখা যাচ্ছে কিছুটা। তবে মুখটা সরস, কিছু বলতে চাওয়ার ভঙ্গি।
সাব্বির মোসাদ্দেক আরো একটু ঝুঁকে বসলেন মানুষটির দিকে, ‘আপনি নিঃসংকোচে বলুন।’
আরো একটু নড়েচড়ে বসলেন মানুষটি। হাত দুটো একবার টেবিলে রাখতে নিয়েই ফিরে নিলেন আবার নিজের কোলে। নিচু করে ফেললেন মাথাটা। তারপর কিছুটা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘আমার নাম গৌরাঙ্গ ভৌমিক। লেখাপড়া সামান্য। কৃষি কাজ করি আমি।’
‘নিজের ক্ষেতে?’
‘জি।’
‘খুবই চমৎকার একটা ব্যাপার। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একজন কৃষক-মন লুকিয়ে থাকে, এটা ওটা চাষ করতে চায় সে, বারান্দায় ফুল গাছ কিংবা টবে মরিচ-পেয়াজ লাগান। ছাদে থাকলে ছাদ বাগান। ঘরের মাঝেও ইনডোর অনেক গাছ লাগিয়ে তৃপ্তি লাভ করেন।’ মোবাইল বেজে উঠল সাব্বির মোসাদ্দেকের, রিসিভ করলেন না তিনি। বরং গৌরাঙ্গ ভৌমিকের দিকে মনোযোগ দিলেন, ‘আপনার এখানে আসার কারণটা বলুন এবার।’
‘আমি একটা মামলা করতে এসেছি।’
‘মামলা?’
‘জি।’
‘মামলাটা কার বিরুদ্ধে?’
‘ভগবানের বিরুদ্ধে।’
‘ভগবানের বিরুদ্ধে!’ হাসতে নিয়েই চেহারাটা সিরিয়াস করে ফেললেন সাব্বির মোসাদ্দেক, ‘ভগবান কী করেছে আপনার?’
‘করেছে তো অনেককিছু। তবে আজ একটার কথা বলব।’
গৌরাঙ্গ ভৌমিকের দিকে একটু কুঁজো হয়ে বসলেন সাব্বির মোসাদ্দেক। দৃষ্টি গভীর হলো, কিন্তু হাসিটা ফিরে এলো ঠোঁটের কোনায়। গালে মশা বসার জায়গাটায় চুলকিয়ে নিলেন একবার। হাতটা ফিরিয়ে এনে নখগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি ঘামছেন। একটু রেস্ট নিন, তারপর বলুন।’
‘আমি কেন ঘামছি, ঠিক তা বুঝতে পারছি না। ভগবানের বিরুদ্ধে মামলা করতে এসেছি, এর জন্য ঘামছি কিনা, তাও বুঝতে পারছি না।’
‘ভগবানকে ভয় পান?’
‘মানুষ অনেক কিছুতে অনেক কিছুকেই ভয় পায়। কিন্তু এ জগতের স্রষ্টা, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, প্রচন্ড শক্তিশালী ভগবানকে ভয় পায় না, ভয় করতে চায় না।’ ‘আপনি সত্য বলেছেন।’
‘আমার এলাকার বড় একটা মন্দির আছে। আমরা বলি ভগবানের ঘর। ওই ঘর বানাতে আমি কিছু টাকা দিয়েছি।’ গৌরাঙ্গ ভৌমিক গলাটা নিচু করে বললেন, ‘আমার অনেক আত্মীয়-স্বজনও দিয়েছে।’
‘খুবই ভালো কথা।’
‘গতকাল সন্ধ্যায় আমি ওই মন্দিরে গিয়েছিলাম। জুতো জোড়া বাইরে রেখে ভেতরে পুরোহিত মশাইয়ের কথা শুনেছি অনেকক্ষণ। ঘণ্টখানেক পর বাইরে এসে দেখি জুতো জোড়া নেই।’
‘চুরি হয়ে গেছে!’
‘সেটা তো ভগবানের জানার কথা।’
কিছু বললেন না সাব্বির মোসাদ্দেক। মাথাটা কেবল উঁচু-নিচু করলেন বার কয়েক।
‘ভগবানের ঘরটা ভগবান নিজে বানাননি, আমরা বানিয়েছি। সেটা টাকা-পয়সা দিয়ে রক্ষাও করি আমরা। সাফ-সুতোর করি, পরিচর্যা করি। সেখান থেকে যদি কোনও কিছু হারিয়ে যায়, সেটা প্রথমত ভগবানের লজ্জা। কিন্তু আমরা তো বুঝতে পারি না ভগবান আদতে লজ্জা পান কিনা? তাই তার বিরুদ্ধে জুতো চুরির মামলা করতে এসেছি, যে ভগবান আমাদের রক্ষা করেন বলে এর ওর মুখ থেকে শুনি প্রতিদিন; আমাদের জীবন নিরাপদ রাখেন তিনি সবসময়, কথাটা কানে আসে প্রায়ই; মন্দিরে গেলে হাজারো গুণ-কীর্তণ তার। অথচ তার নিজের ঘরটাই নিরাপদ নয়।’
‘আপনি তাই মনে করেন?’
‘মনে করার তো কিছু নেই। যা সত্য, তাই বললাম।’
‘কিন্তু ভগবানের বিরুদ্ধে কি কখনো মামলা করা যায়?’ মুখটা হাসি হাসি করে ফেলেন সাব্বির মোসাদ্দেক।
‘তাহলে কার বিরুদ্ধে করা যায়?’ গৌরাঙ্গ ভৌমিক হাতের কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন সাব্বির মোসাদ্দেকের দিকে, ‘এই যে রাষ্ট্রটা চলছে, আমরা এটা সচল রাখার জন্য ট্যাক্স দেই প্রতি বছর। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের তেমন নিরাপত্তা দেয় না, দিতে পারছে না। আমরা যততত্র মারা যাচ্ছি, সম্পদ হারাচ্ছি, যখন-তখন চুরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক কিছু। তাহলে রাষ্ট্রের একজন প্রতিনিধি হিসেবে মামলাটা আপনার বিরুদ্ধেই করি?’
‘আমার বিরুদ্ধে করবেন!’ হাসিটা এবার শব্দময় হয়ে ওঠে সাব্বির মোসাদ্দেকের, ‘কীসের মামলা করবেন?’
গৌরাঙ্গ ভৌমিক দ্বিধাহীন এবং স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘ওই যে, ওই জুতো চুরির মামলা! কারণ মন্দিরটা তো রাষ্ট্রেরই একটা অংশ।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-mamla

  1. বেশ অন্যরকম লাগলো। ভাবনা দারুণ। নিবেদন ঝরঝরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *